পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার|20

অনুরূপ রচনা: পরিবেশ দূষণ ; পরিবেশ দূষণ ও আমাদের করনীয় ; পরিবেশ সংরক্ষণ; মানবজীবনে পরিবেশের প্রভাব;পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য ;নগর জীবনে পরিবেশ সমস্যা; পরিবেশ দূষণ ও সভ্যতার সংকট ; পরিবেশ দূষণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ; বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের কারন ও ফলাফল;পরিবেশ বিপর্যয়

পরিবেশ দূষণ রচনার পয়েন্ট :

ভূমিকা— পরিবেশ দূষণ কী— পরিবেশ দূষণ সমস্যা — পরিবেশ দূষণের কারণ— বায়ু দূষণ ও বায়ু দূষণের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া- বাংলাদেশে বায়ু দূষণের বিভিন্ন কারণ — পানি দূষণ ও পানি দূষণের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া – বাংলাদেশে পানি দূষণের বিভিন্ন কারণ— শব্দ দূষণ ও শব্দ দূষণের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া—বাংলাদেশে শব্দ দূষণের বিভিন্ন কারণ — মৃত্তিকাজনিত দূষণ – তেজস্ক্রিয়তাজনিত দূষণ -পরিবেশ রক্ষায় বালাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ — পরিবেশ সংরক্ষণে করণীয় – উপসংহার।

পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
পরিবেশ দূষণ

ভূমিকা : পরিবেশ মানবসভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সভ্যতার ক্রমবিকাশ থেকেই মানুষ ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে তার পরিবেশ। মানুষের রচিত পরিবেশ তারই সভ্যতার বিবর্তনের ফসল। পরিবেশই প্রাণের ধারক, জীবনীশক্তির জোগানদার।

যুগে যুগে পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে প্রাণীর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার ওপরেই তার অস্তিত্ব নির্ভরশীল। পরিবেশ প্রতিকূল হলে তার ধ্বংস ও সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী। পরিবেশের বিরুদ্ধতা বেঁচে থাকার পথকে অবলীলাক্রমে রুদ্ধ করে। পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণিজীবনের বিকাশ ঘটে। তাই পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে রয়েছে এক নিবিড় যোগসূত্র।

কিন্তু নানা কারণে পরিবেশ দূষণ সমস্যা প্রকট হওয়ায় মানবসভ্যতা আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। এ থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে চলছে নানা গবেষণা। এ লক্ষ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য জাতিসংঘ ৫ জুনকে ঘোষণা করেছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে।

পরিবেশ দূষণ কী :

পরিবেশ দূষণ হলো মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে পরিবেশের উপাদানে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ। পরিবেশ কোনো একটি জীবের অস্তিত্ব বা বিকাশের ওপর ক্রিয়াশীল সামগ্রিক পারিপার্শ্বিকতা, যেমন চারপাশের ভৌত অবস্থা, জলবায়ু ও প্রভাববিস্তারকারী অন্যান্য জীব ও অজৈব উপাদান।

কোনো কারণে এই পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়াকে পরিবেশ দূষণ বলে। বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, মাটি দূষণ, খাদ্য দূষণ, আর্সেনিক দূষণ, তেজস্ক্রিয় দূষণ, ওজোন গ্যাস হ্রাস, গ্রিন হাউস ইফেক্ট ইত্যাদি সবকিছুই পরিবেশ দূষণের অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত মানব সৃষ্ট বিভিন্ন কারণই পরিবেশ দূষণের জন্যে বিশেষভাবে দায়ী।

পরিবেশ-দূষণ সমস্যা :

বিশ্ব পরিবেশের দ্রুত অবনতি হচ্ছে, বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে এ অবনতি হয়েছে আরো দ্রুত। বাংলাদেশে ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন পাস হয়েছে। কিন্তু জনবিস্ফোরণ, বনাঞ্চলের অবক্ষয় ও ঘাটতি এবং শিল্প ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাবের দরুন দেশের পরিবেশ এক জটিল অবস্থার দিকে পৌঁছতে যাচ্ছে।

মানুষ নিজের প্রয়োজনে প্রকৃতিকে যেমন কাজে লাগাচ্ছে বা প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করছে, প্রকৃতিও তেমনি ছিন্ন-ক্লিন্ন-আহত রূপ নিয়ে মানুষের তথা সমগ্র প্রাণপুঞ্জের ঠিক সমপরিমাণ বিরোধিতা করতে তৎপর। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানের বিজয় গৌরবে মোহান্ধ মানুষ পৃথিবীর পরিবেশকে বিষাক্ত করেছে। আজও করছে। ছড়িয়ে দিয়েছে ক্ষতিকর সব আবর্জনা। তার ফল হয়েছে বিষময়। পরিবেশ দূষিত হয়েছে। আর দূষিত পরিবেশ প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। তাই গোটা জীবজগতের অস্তিত্বই আজ বিপন্ন।

দৈনন্দিন জীবনে নানা ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার ক্রমশই বাড়ছে। এর অপরিহার্য কুফল হচ্ছে বায়ু, পানি, মাটি, খাদ্যদ্রব্য ও জীবিত-কোষ দূষণ। গবেষকদের মতে, ক্যানসার রোগের দ্রুত প্রসারের পেছনে এবং জন্ম-সংক্রান্ত নানারূপ বিকৃতি বা বৈকল্য বাড়বার মূলে রয়েছে আমাদের পরিবেশে ছড়িয়ে থাকা নানাবিধ রাসায়নিক দ্রব্য।

কৃত্রিম উপায়ে প্রস্তুত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ থেকে বায়ু, খাদ্যদ্রব্য এবং পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। বর্তমানের পরিবেশ দূষণ মানবসভ্যতার জন্যে বিরাট হুমকি স্বরূপ। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট পরিবেশবিজ্ঞানী Peter Walliston উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য : ‘Environmental pollution is a great threat to the existence of living beings on the earth.”

পরিবেশ-দূষণ সমস্যা
পরিবেশ-দূষণ সমস্যা

পরিবেশ-দূষণের কারণ :

পরিবেশ দূষণের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে প্রধান কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ :

১। জনসংখ্যা বৃদ্ধি
২। অপরিকল্পিত নগরায়ন
৩। বনভূমির অপরিকল্পিত ব্যবহার
৪। প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার
৫। দ্রুত শিল্পায়ন
৬। সার ও কীটনাশকের ব্যবহার
৭। বনভূমি উজাড়
৮। কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ
৯। গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া
১০। ওজোন স্তরের ক্রমাবনতি
১১। অ্যাসিড বৃষ্টি
১২। অপরিকল্পিত গৃহ নির্মাণ
১৩। দারিদ্র্য
১৪। প্রসাধন সামগ্রী
১৫। প্লাস্টিক ইত্যাদি।

বায়ু-দূষণ ও বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া:

আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম সম্ভার হলো বায়ু। সেই বায়ু-দূষণ আজ বিশ্ব জুড়ে। ঝুল জাতীয় কার্বন কণা থেকে ভারী ধাতু, জটিল জৈব যৌগ নিউক্লীয় আবর্জনা, জীবাশ জ্বালানি অর্থাৎ তেল, কয়লা ইত্যাদি পুড়িয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়া, ক্লোরোফ্লুরোমিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, আলোক রাসায়নিক ধোঁয়াশা ইত্যাদি সবই হলো বায়ু দূষণের প্রধান উপকরণ।

তাছাড়া বায়ু-দূষণের মূলে আছে কলকারখানা, মোটর গাড়ি, ট্রেন, ঘরবাড়ি ও ব্যবসায়-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের উত্তাপ সৃষ্টির যন্ত্রপাতি এবং নানা আবর্জনা। বিভিন্ন অক্সাইড বাতাসের জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে তৈরি করে সালকার এবং নাইট্রোজেনের অম্ল। এই অম্ল পরে নিচে নেমে এসে পানি ও মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এরই নাম অ্যাসিড রেইন’ বা অম্লবর্ষণ।

সাম্প্রতিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, এসব গ্যাস ১০০০ কিলোমিটার কিংবা তার চেয়েও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে এবং জল ও স্খলভাগের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করে। এর ফলে মাটি, নদী ও হ্রদ ইত্যাদির পানিতে অম্লের পরিমাণ বাড়ে, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বায়ু দূষণের আর একটি দিক হলো ভূ-পৃষ্ঠের ঊর্ধ্বাকাশে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ভাসমান কণার পরিমাণ বৃদ্ধি।

এসব কণার মধ্যে ধূলিকণা থেকে শুরু করে কলকারখানা থেকে নির্গত নানা প্রকার রাসায়নিক কণাও থাকে। ঊর্ধ্বাকাশে এই সব ভাসমান বস্তুকণার সঙ্গে জলীয় বাষ্প মিশে গড়ে ওঠে বৃষ্টি-বিন্দু। এর ফলে অকাল বর্ষণ এবং বর্ষণের সঙ্গে ঝড় ও শিলা বৃষ্টি হয়ে থাকে। কুয়াশা আর তেল, কয়লা দহনের ফলে নির্গত গ্যাসের মিশ্রণে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে। তার ক্ষতিকারক ক্ষমতা মারাত্মক। মাথাধরা, ব্রংকাইটিস, ফুসফুস ক্যান্সার দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি এ জাতীয় দূষণের ফল।

বায়ু দূষণের বিপর্যয় সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, বায়ুতে যদি কার্বন ডাই-অক্সাইড ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর তার ফলে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের গড় তাপমাত্রা যদি ২০ সে. বৃদ্ধি পায় তাহলে উত্তর সাগরের বরফ গলে হয়ে উঠবে সাগরের পানি।

আর বহু কোটি টন কয়লার ধোঁয়া আর ধুলোবালি যদি প্রাণদায়ী সূর্যালোককে পৃথিবীতে পৌঁছতে বাধা দেয় তবে তার ফল হবে আরো ভয়াবহ। যদি এ কারণে পৃথিবীতে আলো আসার পরিমাণ ১.৫% থেকে ২%ও কমে যায় তাহলে ক্রমে মেরু অঞ্চলের চিরস্থায়ী বরফ ছড়িয়ে পড়বে বিষুব অঞ্চল পর্যন্ত। এতে জাগান, মায়ানমার, বাংলাদেশসহ অনেক সমুদ্র তীরবর্তী দেশ চিরতরে পানির নিচে তলিয়ে যাবে। একে বলে গ্রিন হাউ প্রতিক্রিয়া।

বাংলাদেশে বায়ু দূষণের কারণ :

বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানি দহন ছাড়াও বায়ুদূষণের অন্যান্য উৎসের মধ্যে। রয়েছে ইটের ভাটা, সার কারখানা, চিনি, কাগজ, পাট ও বস্ত্র কারখানা, সুতা কল, চামড়া শিল্প, পোশাক শিল্প ি তৈরির কারখানা, রাসায়নিক ও ঔষধ তৈরি শিল্প, সিমেন্ট উৎপাদন, গ্রিল ও দরজা-জানালার ওয়ার্কশপ, জমির ধূলাবাধে,

পানি দূষণ ও পানি-দূষণের প্রতিক্রিয়া :

পানি দূষণ অগ্রসরমান সভ্যতার আর এক অভিশাপ। পৃথিবীর সমুদ্র নদ-নদী, পুকুর, খাল-বিল ইত্যাদির জল নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। ভারী ধাতু, হ্যালোজেন বিষাক্ত হাইড্রোকার্বন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, পেট্রোলিয়াম, কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা, সর্বোপরি সংলগ্ন শহরের নির্গমনালি বেয়ে আসা দূষিত তরল আবর্জনা এগুলোই হলো সমুদ্র দূষণের কারণ। পানির উৎস হিসেবে যে-সব নদীর পানি ব্যবহৃত হয়, কোনো কোনো সময় সে-সবের মধ্যে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত দূষিত তরল পদার্থ বা পরিত্যক্ত পানি থাকে। নদীর তীরে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ জনপদ শহর।

প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক পাটকল, কাপড় কল, চিনি কল, কাগজের কল, ভেষজ কল ইত্যাদি। এইসব কলকারখানার আবর্জনা প্রতিনিয়ত নদ নদীর পানিকে দূষিত করছে। দ্রুত শিল্পায়ন বিভিন্ন দেশের পানি সরবরাহের এবং আবর্জনা-নিক্ষেপের সমস্যাকে ক্রমশ জটিল করে তুলেছে। উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশগুলোতে দেখা দিচ্ছে গৃহকার্যে ব্যবহৃত নোংরা পানিকে শোধন করে পুনরায় তা ব্যবহারযোগ্য করে তোলার প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু পরিশোধন করণ-ব্যবস্থায় সামান্যতম ত্রুটি থাকলে এ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে গুরুতর রকমের সংক্রমণ ঘটতে পারে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালকে “ইন্টারন্যাশনাল ড্রিংকিং ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড স্যানিটেশন” দশক হিসেবে পালন করার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। কার্যত এ উদ্যোগ নানা কারণে ব্যাহত হয়ে চলেছে।

বাংলাদেশে পানি দূষণের কারণ :

শিল্প ও পৌর বর্জ্য বাংলাদেশের নদী ও জলাশয়গুলোকে দূষিত করছে। পরিবেশ অধিদপ্তর উল্লেখ করেছে যে চট্টগ্রামের টিএসপি সারকারখানা থেকে সালফিউরিক ও ফসফরিক অ্যাসিড এবং চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলি কাগজের মিল, সিলেট কাগজ মিল, দর্শনার কেরু অ্যান্ড কোম্পানি, খুলনার শিপইয়ার্ড ও মাছ প্রক্রিয়াকরণ কারখানা, ঢাকার অলিম্পিক ও কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলস লক্ষ লক্ষ গ্যালন তরল বর্জ্য পার্শ্ববর্তী নদী ও জলাশয়ে নিক্ষেপ করে পানি দূষণ ঘটাচ্ছে।

চট্টগ্রামের কালুরঘাট, নাসিরাবাদ, পতেঙ্গা, কাপ্তাই, ভাটিয়ারি, বাড়বকুণ্ড, ফৌজদারহাট ও ষোলশহরের প্রায় ১৪০টিরও বেশি শিল্পকারখানার বর্জ্য কর্ণফুলি নদী ও বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর পানি পোস্তগোলা ও ফতুল্লার ৫৩টি কারখানা এবং হাজারীবাগের ১৫১টি চামড়া শিল্প দ্বারা দূষিত হচ্ছে। অন্তত ২৯টি শিল্পকারখানার বর্জ্য টঙ্গী অঞ্চলের তুরাগ নদী এবং ৪২টি বৃহৎ শিল্প শীতলক্ষ্যা নদীতে বর্জ্য নিক্ষেপ করছে। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল ঘণ্টায় প্রায় ৪,৫০০ ঘনমিটার বর্জ্যামিশ্রিত পানি ভৈরব নদীতে ফেলে।

গঙ্গা ভারত থেকে প্রায় ৮,৬২,০০০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত গঙ্গা অববাহিকার বর্জ্য নিয়ে আসে। তীরবর্তী ৭০০ শহরের প্রায় ১২০ কোটি লিটার বর্জ্য প্রতিদিন গঙ্গা নদীর প্রবাহে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এবং ভাটিতে অবস্থিত বাংলাদেশের মানুষ সেই দূষিত পানি ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছে।

ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভে ও বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত হয় যে বাংলাদেশে ১.৮৫ থেকে ২.২৭ কোটি মানুষ ভূগর্ভস্থ আর্সেনিক দূষণযুক্ত পানি ব্যবহার করছে।

শব্দদূষণ ও শব্দ দূষণের প্রতিক্রিয়া:

বর্তমান যুগের এক গুরুতর সমস্যা হচ্ছে শব্দদূষণ। শহরাঞ্চলে শব্দ দূষণের মূল উৎসগুলো হচ্ছে— মোটরগাড়ির হর্ন, বাজি ও পটকার আওয়াজ, রেডিও-টেলিভিশনের আওয়াজ, মাইকের অত্যাচার, কলকারখানার শব্দ ইত্যাদি। শব্দ দূষণের পরিণাম শ্রবণেন্দ্রিয় অকেজো হয়ে যাওয়া, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া, স্নায়ুতন্ত্রের ওপর চাপ পড়ে অনিদ্রা এবং নানা প্রকার স্নায়ুরোগের সৃষ্টি হওয়া। এছাড়া, কলকারখানার আশেপাশের বাসিন্দাদের শিশু সন্তানরা কম-বেশি বধির হতে দেখা যায়।

বাংলাদেশে শব্দ দূষণের কারণ :

শব্দ দূষণের প্রকোপ বাংলাদেশের জন্য এক সুদূরপ্রসারী পরিণতিবহ সমস্যা হয়ে উঠছে। গাড়ির হর্ন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোনো ট্রাফিক আইন না থাকায় শহরের অনেক অংশে শব্দসমস্যা অত্যন্ত তীব্র আকার ধারণ করছে।

মৃত্তিকাজনিত দূষণ :

মৃত্তিকা বা মাটি ভূত্বকের উপরিভাগের একটি পাতলা আবরণ। বিভিন্ন কারণে মৃত্তিকা দূষণ ঘটে। যেমন, ভূমিক্ষয়, বায়ু প্রবাহ, বৃষ্টি, গাছকাটা, বন উজাড়, জমিতে অতিরিক্ত বা নিয়মিত রাসায়নিক সার ব্যবহার করা ইত্যাদি কারণে মাটির গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়, ফলে মৃত্তিকা দূষণ ঘটে।

তেজস্ক্রিয়তাজনিত দূষণ :

তেজষ্কিয়তাজনিত দূষণ মানুষের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর এক ধরনের অদৃশ্য দূষণ। তেজস্ক্রিয়তার উৎস সূর্য ও মহাশূন্য যেখান থেকে তা পৃথিবীতে পৌঁছায়। ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয়তার অধিকাংশ বিকিরিত হয়। বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ, বিশেষত পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক সামগ্রী থেকে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লেজার রশ্মি, এক্সরে মেশিন, রঙিন টেলিভিশন সেট, মাইক্লো ওয়েভ ওভেন ইত্যাদি। অধুনা পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের ফলে সৃষ্ট দূষণ বিশ্বব্যাপীমানুষের আতঙ্ক ও উদ্বেগের কারণ হয়েছে।


প্রতিকার ও বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ :

পরিবেশ দূষণ রোধ করার জন্যে সারাবিশ্ব সচেতন হয়ে উঠেছে। পরিবেশ দূষণের ফলে বিশ্বের বিভিন্নস্থানে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে দূষণ রোধ করার প্রচেষ্টা চলে। আমাদের দেশে এ ব্যাপারে সচেতনতার সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্যবস্থা ও কর্মসূচি। গ্রহণ করেছে। যেমন :

১। পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ (২০০২) ঘোষণা ও আইন করা হয়েছে।
2। টু-স্টোর যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব যানবাহনের নির্গত ধোঁয়ায় কার্বন-ডাইঅক্সাইড, সিসা, কার্বন মনোঅক্সাইডসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছিল।

৩।পরিবেশ দূষণরোধে সিএনজি জ্বালানির ব্যবহার আরম্ভ করেছে।
৪। মেয়াদ উত্তীর্ণ যানবাহন নিষিদ্ধ করেছে।

৫। বনায়ন কর্মসূচির ব্যাপক সম্প্রসারণ করা হয়েছে।

৬। পরিবেশ আদালত গঠন করা হয়েছে। এ আদালতের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশে পরিবেশ অপরাধের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা।

৭। সরকার দেশের পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) বিল ২০০২’ এবং পরিবেশ আদালত *(সংশোধন) বিল ২০০২’ নামে দুটি আইন পাস করেছে।

৮। জলবায়ুর পরিবর্তন বিষয়ক আন্তর্জাতিক কর্মশালার আয়োজন করেছে ইত্যাদি।

পরিবেশ দূষণ রোধের উপায়ঃ

পরিবেশ দূষণ রোধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তার কয়েকটি দিক নিচে তুলে ধরা হলো

১। পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে।
২। পরিবেশ রক্ষার জন্যে দেশে মোট আয়তনের শতকরা ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন একথা নিশ্চয়ই কারো অজানা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি হিসেব অনুযায়ী ১৬% বনভূমির কথা বলা হলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে বনভূমির পরিমাণ রয়েছে মাত্র ১%। সুতরাং পরিবেশ সংরক্ষণের জন্যে আমাদের এ মুহূর্তে দেশের মোট আয়তনের ৩০% বনভূমি করা প্রয়োজন।


৩। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে সৌর ও পানি বিদ্যুতের মতো উৎস ব্যবহার করতে হবে।
৪। বনভূমি উজাড়করণ এবং নির্দিষ্ট সময়ের আগে গাছকাটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
৫। শিল্প-কারখানা, গৃহস্থালি ইত্যাদির বর্জ্য পদার্থ নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হবে। এবং পরবর্তী কালে তা সরকারিভাবে পরিশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। ৬। কৃষিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।


৭। কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে।
৮। পরিবেশ দূষণ রোধকে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে।
৯। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করতে হবে।
১০। শিক্ষার হার বাড়াতে হবে।
১১। সরকারি বিভিন্ন পরিকল্পনা ও নতুন নতুন বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

পরিবেশ সংরক্ষণে করণীয় :

এককালে মানুষের ধারণা ছিল প্রকৃতির ওপর যে কোনো উপায়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই সবচাইতে জরুরি। আজ সে ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। কেননা দেখা যাচ্ছে, এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে বন ধ্বংস করে, নদীর প্রবাহ বন্ধ করে, পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে মানুষ নিজের জন্যে সমূহ বিপদ ডেকে এনেছে। তাই আজ প্রকৃতির ওপর আধিপত্য নয়, মানুষ গড়ে তুলতে চাইছে প্রকৃতির সঙ্গে মৈত্রীর সম্মন্ধ। আর চেষ্টা করছে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রেখে প্রকৃতির সহায়তায় তার নিজের জীবনধারাকে আগামী দিনের সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।

উপসংহার : পরিবেশ-দূষণ জাতির জন্যে এক মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ ব্যাপারে সারা বিশ্বের মানুষের সচেতনতার মানসিকতা একান্ত অপরিহার্য। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ সমস্যা আরো প্রকট। তবে দেশ ও জাতির স্বার্থে এর মোকাবেলা অভ্যাবশ্যক। এ লক্ষ্যেই কবি সুকান্তের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই

“এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জান,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”

1 thought on “পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার|20”

Comments are closed.